দুইযুগ আগেও নদী বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ ছিল বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। বিলুপ্ত প্রজাতির বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি ধরনের বন্যপ্রাণী রীতিমতো চোখে পড়তো। অসচেতনতার কারণে হত্যা ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ না থাকায় দিনদিন তা বিলুপ্তির পথে হাটছে।
সাগরের বুক চিড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর সন্দ্বীপে একসময় শিয়াল, মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি, বিভিন্ন প্রজাতির কাছিম ও সাপ, ঘুঘু, প্যাঁচা, সাদা বক,পানকৌড়ি, পাতিহাস, চিল সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও পাখপাখালির নিরাপদ আশ্রয়স্থান হিসাবে পরিচিত ছিল। শীতকালে অতিথি পাখির আগমন ছিল চোখে পড়ার মতো।মানুষের সচেতনতা এবং বন বিভাগের অবহেলার কারনে এসব বন্যপ্রাণীর সংখ্যা এখন শূন্যের কোঠার দিকে এগিয়ে চলছে।
সন্দ্বীপে প্রতিবছর নির্বিচারে পিটিয়ে মারা হচ্ছে মেছোবাঘ। গত ৭ সেপ্টেম্বর মাইটভাঙ্গা ৭ নং ওয়ার্ডের বাঘা মার্কেট এলাকার পাশে জমির পাশ থেকে এলাকার কয়েকজন মিলে একটি মা মেছোবাঘকে পিটিয়ে হত্যা করে। ১৮ জুলাই শনিবার পৌরসভা ৫ নং ওয়ার্ডের সংবাদকর্মী কাউছার মোহাম্মদ দিদারের বাড়ির পাশে স্থানীয় লোকজন একটি মেছোবাঘ পিটিয়ে হত্যা করে উল্লাস করে ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোষ্ট করে। এভাবে প্রতিবছর সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় ১০ থেকে ১৫ টি মেছোবাঘ পিটিয়ে হত্যা করা হয়। উপজেলার বিভিন্ন ধান চাষের জমিতে ফাদ পেতে ও বিষাক্ত খাদ্যের টোপ দিয়ে প্রতিবছর কয়েকশ বক শিকার করা হয়। সেগুলো আবার প্রকাশ্যে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি বক এক থেকে দেড়শ টাকা করে বিক্রি করা হয়। শিকার করা বক বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন এমন পরিবারও রয়েছে সন্দ্বীপে। প্রায় একযুগ ধরে প্রতিবছর শীতকালে একদল পাচারকারী সন্দ্বীপ থেকে গুইসাপ ধরে নিয়ে যায়। বরিশাল, রংপুর, ফরিদপুর থেকে তিন থেকে চারটি দল সন্দ্বীপ এসে কাছিম শিকার করে পাচার করে নেয়। এরা এখানে বাসা ভাড়া করে থেকে বছরে প্রায় নয় মাস পুকুর ও খালবিল থেকে কাছিম ধরে।
দীর্ঘদিন ধরে বন্যপ্রাণী শিকার ও হত্যার মতো অপরাধ ঘটতে থাকলেও নিশ্চুপ উপকূলীয় বন বিভাগের লোকজন। এসব বন্যপ্রাণীর হত্যা ও শিকার করার কথা তাদের জানালেও এপর্যন্ত কোন ধরনের ব্যবস্থা নেননি।
এনাম নাহাড় মোড়ের জুয়েলারি ব্যবসায়ী বিজয় বনিক জানান, গত দুই বছর ধরে কাছিম বিক্রেতাদের থেকে আমি প্রায় ৫০ টি কাছিম কিনে আমার পুকুরে ছেড়ে বাচিয়ে দিয়েছি।
মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের ষাটোর্ধ বয়সের মো. আবদুল বাতেন বলেন, বাঘডাশা বা মেছোবাঘ মানুষের হাস মুরগী, ছাগল ভেড়ার বাচ্চা খেয়ে ফেলে। অনেক সময় মানুষের উপর হামলা করে নখ দিয়ে আঁচড় দেয়। তাই বাগডাশ (মেছোবাঘ) দেখলে পিছিয়ে মেরে ফেলে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জানা না থাকায় মানুষ বন্যপ্রাণী হত্যা করছে বলে মন্তব্য করছেন সচেতন মহল। মাইটভাঙ্গা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো.আলোমগীর জানান, বন বিভাগ থেকে সন্দ্বীপের প্রতিটি এলাকায় মাইকিং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও হাটবাজারে হ্যান্ডবিলের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ করতে সচেতনতা মূলক প্রচারণা করলে এবং মানুষকে বন্যপ্রাণী হত্যার কারণে কি ধরনের শাস্তি রয়েছে তা জানিয়ে দিলে বন্যপ্রাণী হত্যার প্রবণতা ও হার অনেক কমে যাবে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা বন কর্মকর্তা মো.নিজাম উদ্দিন বলেন, এপর্যন্ত আমি বন্যপ্রাণী হত্যার সঠিক কোন তথ্য প্রমাণ পাইনি। কিছুদিন আগে একটা মেছোবাঘ পিটিয়ে হত্যার খবর শুনে আমি লোক পাঠাই। তারা কোন সত্যতা পায়নি। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কথা স্বীকার করে জানান, আমি উপজেলা পরিষদের মিটিং গুলোতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করার প্রচারণার কথা বলেছি। আসলে আমাদের লোকজন কম তাই এসব দেখাশোনা করতে পারছিনা।
তবে নাম প্রকাশে আমানউল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদাত চৌধুরী বলেন, বন কর্মকর্তার বাড়ি সন্দ্বীপ হলেও তিনি সন্দ্বীপ পোস্টিং নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম। তিনি কিভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করবেন।