ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি আরবের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটি যখন প্রকাশ্যে আসে, জো বাইডেন তখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। সে সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশ্বমঞ্চে সৌদি আরবকে অস্পৃশ্য করে রাখা উচিত। তবে মধ্যপ্রাচ্য সফরের অংশ হিসেবে বুধবার ইসরাইলে আসার পর শুক্রবার বাইডেন তার বর্ণিত ‘অস্পৃশ্য’ দেশটিতে গেছেন!
কিন্তু কেন? বাইডেনের নিজের লেখা একটি নিবন্ধ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে; ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় জ¦ালানি তেলের স্বার্থরক্ষা ও সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা আনার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী ঐক্য জোরদার করার লক্ষ্য রয়েছে তার। পাশাপাশি বাইডেন এই অঞ্চলে চীনবিরোধী রাজনীতিকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে মার্কিন কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ করতে চান। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইসরাইল আর আমিরাতের মধ্যে ‘আইটুইউটু’ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করাও তার লক্ষ্য।
সৌদি আরব প্রশ্নে বাইডেনের নির্বাচন-পূর্ববর্তী অবস্থান : ইয়েমেনে সৌদি জোটের আগ্রাসী যুদ্ধে ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ সমর্থন থাকলেও দৃশ্যত বাইডেনের অবস্থান ছিল এর বিপরীতে। এরপর জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনি সৌদি বাদশাহ সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) ওপর এতটাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন যে নির্বাচনি প্রচারণায় বাইডেন ঘোষণা দেন, সৌদি শাসকগোষ্ঠীকে তিনি একঘরে করে ছাড়বেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, এ হত্যাকাণ্ডের কারণে বিশ্বমঞ্চে সৌদি আরবকে ‘অস্পৃশ্য’ করে রাখা উচিত।
ক্ষমতায় গিয়েও তিনি সৌদি যুবরাজ সালমানের সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে অস্বীকার করেন। তিনি বলতে শুরু করেন বাইরের যেকোনো দেশের সঙ্গে তার সরকারের সম্পর্কের ভিত্তি হবে মানবাধিকার। সৌদি যুবরাজ তার সঙ্গে কথা বলতে কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সৌদি আরবের কাছে নতুন অস্ত্র বিক্রিও স্থগিত করেন বাইডেন। এমনকি সৌদি আরবে সফরের খবর নিশ্চিত হওয়ার পরও অর্থাৎ গত জুনেও বাইডেন বলেন, যুবরাজ সালমানের সঙ্গে তার কোনো কথা হবে না। কিন্তু পরে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় দুজনের মধ্যে জেদ্দায় কথা হবে।
বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সবথেকে বড় ক্রেতাদের একটি হলো সৌদি আরব। দশকের পর দশক ধরে প্রধানত নিজেদের অস্ত্র বিক্রি ও জ্বালানি তেলের স্বার্থে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে। নাইন ইলেভেনের টুইন টাওয়ার হামলায় সৌদি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিললেও এ নিয়ে সৌদি আরবকে তেমন কোনো অসুবিধার মুখে পড়তে হয়নি কখনও। বাইডেন অস্পৃশ্য বললেও তাই সৌদি আরবই তার গন্তব্য হয়েছে, তিনি দেখা করেছেন এমবিএসের সঙ্গেও।
স্বনামধন্য মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম ট্রুথ আউটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর সব রেকর্ড অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক সবসময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ পথে এগিয়েছে।’
কেন অবস্থান বদলালেন বাইডেন : কদিন আগে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় নিজের লেখা এক নিবন্ধে বাইডেন তার সৌদি সংক্রান্ত নীতি বদলের একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, সৌদি আরবকে ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দেওয়ার নীতি তিনি বদলে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ইউরোপে যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের এবং সৌদি আরবের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করছেন। বাইডেন লিখেছেন, ‘আমাদের রুশ আগ্রাসনের পাল্টা পদক্ষেপ নিতে হবে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের শক্ত অবস্থান প্রয়োজন … এ কারণে সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে, যারা আমাদের চেষ্টায় সাহায্য করতে পারে। সৌদি আরব তেমন একটি দেশ।
ইসরাইল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ : ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাইডেনের সৌদি সফরের প্রধান দুই কারণ জ্বালানি তেল ও ইসরাইল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। বাইডেনের প্রতি ইসরাইলের চাওয়া, তিনি যেন আব্রাহাম চুক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সহযোগিতা চুক্তি) স্বার্থে মোহম্মদ বিন সালমান এবং সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেন। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে হোয়াইট হাউসের এক ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের এবারের থিম হচ্ছে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার রোডম্যাপ। তবে এ বিষয়ে খুব বেশি বিস্তারিত তথ্য হোয়াইট হাউস দেয়নি। হোয়াইট হাউস জানায়, বাইডেনের সফরের আগে কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে তারা এ ধরনের কিছু করার চেষ্টা করছে। চুক্তির বিষয়ে বাইডেন ইসরাইল ও সৌদি নেতাদের সঙ্গে সফরে আলোচনা করবেন। হোয়াইট হাউস বলছে, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যেকোনো রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সময় লাগবে। এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
অন্য আরেকটি সূত্র এ বিষয়ে বলেছে, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন হতে পারে। হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের এক মুখপাত্র বলেছেন, তারা আরব-ইসরাইল সম্পর্ক প্রসারিত ও গভীর করার জন্য সহায়তা করছেন।
ইসরাইলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি বাইডেনের সফরের সময় সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে বড় ধরনের অগ্রগতির আশা করেন না। তবে সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে ভারত ও চীনে যাতায়াতের অনুমতিসংক্রান্ত চুক্তির খুব কাছাকাছি তারা। এরই মধ্যে সৌদি আরব তাদের আকাশসীমা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
জ্বালানি তেলের স্বার্থ : ইউক্রেন সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারে ভয়াবহ অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বাইডেনও বুঝতে পারছেন বাড়তি সৌদি তেল এখন আমেরিকার জন্য জরুরি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা মিডল-ইস্ট ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান কাটুলিস ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘ছেলেমানুষি কাটিয়ে বাইডেনের প্রশাসন অভিজ্ঞ হতে হতে শুরু করেছে। বিষয়টা এমন নয় যে, আপনি এই ব্যক্তিকে (সৌদি যুবরাজ) ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবেন। ফলে, জটিল এই পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সামাল দিয়ে নিজের স্বার্থ দেখা … মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার এমন নীতির ভূরি ভূরি নজির রয়েছে।’ অর্থাৎ সৌদি আরবের ব্যাপারে আমেরিকার গতানুগতিক বিদেশ নীতির পথে ফিরে গেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। ট্রুট আউটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাই নোম চমস্কি বলেছেন, বাইডেনের সৌদি সফর মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নীতিরই প্রতিধ্বনি। ডেমোক্রেসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাউয়ের নির্বাহী পরিচালক রাহ লিয়া হুইটসন বাইডেনের সফরের সমালোচনা করে বলেছেন, এটা নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ।
ডেমোক্র্যাসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাউয়ের নির্বাহী পরিচালক সারাহ লিয়া উইসটন বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম ডেমোক্র্যাসি নাউকে বলেছেন, আমরা যদি তেলের দামের জন্য আত্মত্যাগ করতে ইচ্ছুক হই, তাহলে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারের জন্য জঘন্য সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার [দরকার নেই]। এর চেয়ে অনেক কম ত্যাগ স্বীকার করেই তা করা সম্ভব।’ তিনি দাবি করেন, রাশিয়ার তেলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এরচেয়ে ভালো সমাধান।
শান্তিতে নোবেল জয়ী ইয়েমেনের অধিকারকর্মী তাওয়াক্কোল কারমান বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি ত্যাগ করেছেন বাইডেন।’
চীন-রাশিয়ার প্রভাব বলয় ক্ষুণ্ন করা, মার্কিন স্বার্থ সংহত করা : জেরুজালেমে বৃহস্পতিবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিডের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকে তিনি খাশোগি হত্যাকাণ্ডের কথা তুলবেন কি না। সে প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বাইডেন তার সৌদি সফর নিয়ে সাফাই গেয়েছেন। বলেছেন, ‘অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যের’ স্থিতিশীলতার জন্য এবং এই অঞ্চল যেন ‘চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ঢুকে না পড়ে’ সেজন্য সৌদি আরবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
বাইডেন সরাসরি বলেন, আমেরিকা যখন বিশ্বে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত, সেখানে ‘সৌদিকে অবজ্ঞা করলে আমেরিকার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। এর সঙ্গে এখন আমেরিকার স্বার্থ জড়িত। এই অঞ্চলে আমেরিকার নেতৃত্ব অক্ষত থাকুক আমি তা নিশ্চিত করতে চাই। এমন কোনো শূন্যতা যেন এখানে তৈরি না হয় হয় যেখানে রাশিয়া এবং চীন তা পূরণ করে ফেলে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, এটা অনস্বীকার্য যে ১৮ মাস ধরে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হয়ে যাওয়ায় সৌদি আরব চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের ব্যবসা ক্রমাগত বাড়ছে। এদিকে পুতিনের সঙ্গে যুবরাজ সালমানের সম্পর্কও বেশ উষ্ণ। সব মিলে মধ্যপ্রাচ্যে চীন ও রাশিয়ার কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন করা বাইডেনের সফরের একটা বড় উদ্দেশ্য।
ইউটুইউটু জোটের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : করোনা মহামারি ও প্রতিবেশী ইউক্রেনে পরাশক্তি রাশিয়ার আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ^ব্যাপী চলমান খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কট থেকে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিতে ‘আইটুইউটু’ নামে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা জোট গড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। রিয়াদভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপ্রধানরা খাদ্য ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি নিরাপত্তা খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পানি, জ্বালানি, পরিবহন, মহাকাশ, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে যৌথ বিনিয়োগের পাশাপাশি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাই এই জোটের লক্ষ্য। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪ দেশের নেতারা বলেছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ করবেন। ভারতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আহমেদ আল-বান্না এই জোটকে ‘ওয়েস্ট এশিয়ান কোয়াড’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বাণিজ্যিক সুরক্ষার নিশ্চয়তাও বাইডেনের সফরের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য।